বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামানের ৮০তম জন্মদিন শনিবার।
আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এ টি এম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। তার মার নাম সৈয়দা খাতুন। সৈয়দা খাতুন লেখালেখি করতে ভালোবাসতেন।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন।
তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। দেশভাগের পরে এদেশে এসে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে।
এরপর তিনি পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় ভর্তি হন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রিয়নাথ স্কুলের শেষ ব্যাচ। কারণ তাদের ব্যাচের পরেই ওই স্কুলটি সরকারি হয়ে যায় এবং এর নাম-পরিবর্তন করে রাখা হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৫৭ সালে এমএ পাস করার পর বাংলা একাডেমির প্রথম গবেষণা বৃত্তি পান আনিসুজ্জামান। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শূন্যতায় বাংলা একাডেমির বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ “নীলকান্ত সরকার” বৃত্তি লাভ করেন।
১৯৫৮ সালে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারার’ ওপর পিএইচডি করার জন্য যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি নেন।
আনিসুজ্জামান ছিলেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক। মাত্র ২২ বছর বয়সে বাংলা একাডেমির বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে আনিসুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেন। প্রথমে তার অ্যাডহক ভিত্তিতে চাকরি হলো তিন মাসের। কথা ছিল গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হলেই চাকরি শেষ হয়ে যাবে। সেই চাকরি শেষ হয়ে গেলে, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি পেলেন। এরপর তিনি আবার যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অবস্থান করেছিলেন। পরে ভারতে গিয়ে তিনি প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
তিনি ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। এরপর তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন ।
আনিসুজ্জামান প্রত্যক্ষভাবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। মুজিবনগরে তিনি তাজউদ্দীনের বিচক্ষণ কর্মকাণ্ড সরেজমিনে কাছ থেকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবর রহমান এর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মহান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।
আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, আমার একাত্তর, আমার চোখে, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, নারীর কথা ইত্যাদি।
আনিসুজ্জামান বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদকসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি এখনো দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করছেন। তার জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাই।