১৯৭১ সালের কণ্ঠসৈনিক ও জনপ্রিয় নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ। তার শৈশব ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানান গল্প নিয়ে কথা হয় হ্যালোর সাথে।
হ্যালো- আপনার শৈশব কেটেছে কোথায়?
শাহীন সামাদ- আমার শৈশব কেটেছে ভারতের জলপাইগুড়িতে। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশে চলে আসি। আমরা ছিলাম তিন ভাই তিন বোন। তিন বোনের মধ্যে আমি ছিলাম বেশি চঞ্চল।
তখন আমার বয়স যখন পাঁচ বা ছয় বছর, আমি নীলফামারী গার্লস স্কুলে ক্লাস টুতে ভর্তি হই। ওই স্কুলে আবার গানের প্রতিযোগিতা হতো। শুরুতেই আমি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি আর প্রথম হয়ে যাই। তখন আমার আম্মা বুঝলেন যে আমার মধ্যে একটি প্রতিভা আছে (হাসি)। এরপর তিনি ঠিক করলেন বাড়িতে ওস্তাদ রেখে আমাকে গান শেখাবেন। আমাদের তিন বোনকে গান শেখানোর জন্য ওস্তাদ রাম গোপালকে ঠিক করলেন। এভাবেই গান শেখা শুরু।
এরপর ১৯৬২ সালে আমরা ঢাকায় এসে আদমজি গার্লস স্কুলে ভর্তি হই। তখন আমাদের বাসা ছিল লালবাগে।
১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ বেতারে আব্বার হাত ধরে ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানে যাই। আব্বাই শৈশবে আমার সবচেয়ে আপন মানুষ ছিলেন। সবসময় আমার সাথে সাথে থাকতেন। আমার বয়স যখন ১৪ বছর, আব্বা মারা যান। তবে এখনও মনে হয় আব্বা আমাদের সাথেই আছেন।
হ্যালো- ছোটো বেলার কোনো স্মরণীয় ঘটনার কথা বলবেন?
শাহীন সামাদ- আমি মেট্রিকে খুব ভালো ফল করেছিলাম। কলেজেও খুব ভালো করেছিলাম। ছায়ানটে আমি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলাম। আমাদের কলেজে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও ফার্স্ট হতাম। এডুকেশনাল উইকে ফার্স্ট হতাম। এখনও মনে পড়ে দিনগুলোর কথা!
হ্যালো- শিল্পী হওয়ার পেছনে পরিবারের কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
শাহীন সামাদ- শিল্পী হিসেবে বেড়ে ওঠার পেছনে আমার আব্বা-আম্মার অবদান সবচেয়ে বেশি। তারা দেশের সংস্কৃতিকে খুব মূল্যায়ন করতেন।এছাড়াও তারা আমাকে ছোটবেলা থেকেই খুব স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছেন। তাদের জন্যই আজ আমি জীবনের এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।
হ্যালো- মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের কোনো বাধা ছিল?
শাহীন সামাদ- অব্যশ্যই! মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দেশ ত্যাগ করেছিলেন, তারা অনেকেই পরিবারসহ দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তবে আমি কিন্তু একা ছিলাম। পরিবার থেকে আম্মার দিক থেকে একটা বড় বাধা ছিল। আম্মা, ভাই, বোন পুরো পরিবারকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। সে সময় পরিবারের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারা কেউ জানতেন না, আমি বেচেঁ আছি কি না!
হ্যালো- মুক্তিযুদ্ধে আপনার অংশগ্রহণের কথা শুনেছ্ন? যুদ্ধে আপনার ভূমিকা কী ছিল?
শাহীন সামাদ- মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের শিল্পীদের একটা দল ছিল। শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতাম।
শিল্পী সংস্থার যারা বিবাহিত ছিলেন, তারা একশ টাকা এবং যারা অবিবাহিত তারা ৫০ টাকা করে পেতাম। এই টাকা দিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাঁড়ি-পাতিল, শুকনো খাবার ইত্যাদি কিনতাম।
হ্যালো- মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে কীভাবে যুক্ত হলেন?
শাহীন সামাদ- ১৯ এপ্রিল ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় যাই। ওখানে গিয়ে শুনলাম ১৪৪ নম্বর লেলিন সরণীতে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটি সংস্থা হয়েছে।পরে এর নাম পাল্টে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ শিল্পী সংস্থা’। সেখানে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক দীপেন বন্দোপাধ্যায়ের বাসায় আমাদের এই সমিতির কাজ চলত।তিনি তার বাসার নিচ তলা আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন।
হ্যালো- শিল্পী সংস্থায় কারা ছিলেন?
শাহীন সামাদ- মোস্তফা মনোয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলি জাকের, আসাদুজ্জামান নূর, স্বপন চৌধুরী, লতা চৌধুরী, দেব ভট্টাচার্য্য, বিপুল ভট্টাচার্য্য, শারমীন মুরশেদসহ আরও অনেকেই ছিলেন।
হ্যালো- সে সময়ের স্মরণীয় কিছু গানের কথা বলুন।
শাহীন সামাদ- পাক পশুদের মারতে হবে, বাংলা মার দুর্নিবার, একবার তোরা মা বলিয়া ডাক, একি অপরূপ রূপে মা তোমায়, শিকল পরার ছল, মানুষ হ মানুষ হ, আমার প্রতিবাদের ভাষা, এ গানগুলোর কথাই মনে পড়ে।
হ্যালো- এখনকার শিশুদের কিছু বলতে চান?
শাহীন সামাদ- আমি মনে করি আমরা যেভাবে দেশকে স্বাধীন করেছি, দেশকে এগিয়ে নিয়ে এসেছি, ঠিক সেভাবেই বর্তমান প্রজন্ম দেশকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
নিজ মাতৃভূমিকে মন থেকে ভালোবাসতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজের মা যেমন সবার কাছে আপন, মাতৃভুমিও ঠিক সেইরকম! মা আর মাতৃভূমি একই রকম।
শিশুরা যখন এই বিষয়টি শিখতে পারবে, মনে ধারণ করতে পারবে, তখন দেশের জন্য তারা সব কিছু করতে পারবে, ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে।