মুক্তিযুদ্ধে শিশুরা আত্মত্যাগ করলেও ইতিহাসে তাদের অনেকেরই নাম লেখা হয়নি বলে আক্ষেপ করেছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান চন্দন।
২৫ ডিসেম্বর শুক্রবার রাজধানীর উত্তর কাফরুল এলাকায় এক্স স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন অব উত্তর কাফরুল হাইস্কুল আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “তোমাদের বয়সী যুবকেরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছে, শিশুরাও।”
যুদ্ধে এক শিশু যোদ্ধার আত্মত্যাগের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “আমরা তখন গিতালদাহ ক্যাম্পে। অপারেশন থেকে ফিরে রেললাইনে বসে কথা বলছি। এমন সময় ১১-১২ বছর বয়সী একটা ছেলে আসে। ওর নাম-ফেলু মিয়া। বাড়ি কুড়িগ্রাম নাগেশ্বরীর রামখানা কাশিপুরে।
ও বলে,‘ভাইজান, আমি যুদ্ধ করব আপনাদের সঙ্গে।’
“আমার সহযোদ্ধারা হেসে বললেন, তুমি আবার যুদ্ধ করবে কীভাবে? তোমার বয়স তো কম।
“তখন সে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। বলে, ওর বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে ধরলা নদীতে ফেলে দিয়েছে। ওর মা ওকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “তার মনোবল দেখে আমরা তাকে ইনফরমার হিসেবে নিয়োগ করি। সে আমাদের তথ্য এনে দিত কোথায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প, কোনদিক দিয়ে তারা চলাচল করে।
“তার খবর সব পারফেক্ট হতো। অপারেশনও সাকসেস্ফুল হতো। কয়েকটি অপারেশন হওয়ার পর হঠাৎ ছেলেটাকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমরাও যুদ্ধের সময় বলে আর খোঁজ করিনি। ভেবেছি মায়ের কাছে চলে গেছে।”
“স্বাধীন হওয়ার পর পর বন্ধু হাফিজকে নিয়ে আমরা তার গ্রামের বাড়ি যাই। গিয়ে জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেওয়ার অপরাধে রাজকাররা তাকে ধরে নিয়ে টর্চার করে হত্যা করে। একটা শিমুলগাছের নিচে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে।”
দুঃখ করে মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান বলেন, “এই শিশু ফেলু মিয়া এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। সে পালিয়ে যায়নি। টর্চারের পরও আমাদের অবস্থানের কথা জানায়নি। বরং সে জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। সে কোনো উপাধি পায়নি। এই রকম শত শত ফেলু মিয়ার মতো শিশু দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাদের কথা আজও ইতিহাসে লেখা হয়নি।”
তিনি ছোটদের উদ্দেশ্যে বলেন, “১৯৭১ এ তোমার পূর্ব পুরুষরাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, এই দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন।
“ফেলু মিয়ার মতো তোমরাও দেশকে ভালবেসো। মনে রেখ, মুক্তিযুদ্ধ কোনো গল্প নয়। মুক্তিযুদ্ধ ঘটনা, ইতিহাস। সে ইতিহাসে শিশুদেরও বীরত্ব ও গৌরবের কথা রয়েছে।”
কাজী জাকির হাসান চন্দন ভারতের শিলিগুড়ির মূর্তি ক্যাম্প থেকে ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ নেমেছিলেন। যুদ্ধ করেছেন ছয় নং সেক্টরের লালমনিরহাট সাব সেক্টরে।
সেক্টরের ফুলবাড়ির গোরপমণ্ডল এলাকায় অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইন বিষ্ফোরণে এই যোদ্ধার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উড়ে যায়। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পা নিয়ে চলাফেরা করছেন।