শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরির সেমিনার রুমে চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন শেষে হ্যালো পেয়ে গেল চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে।

শিশুদেরকে নিয়ে তার কাজ, ভাবনার কথা সবার জানা। হ্যালোর বন্ধুদের জন্যে রইল তার শৈশব ও কৈশোরের নানা গল্প।

হ্যালো: স্যার, আপনার ছোটবেলাটা কেমন ছিল?   

মুস্তাফা মনোয়ার: আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কত মজাই না করেছি। কত আনন্দ করেছি। মজার ফাঁকে ফাঁকে আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু এখন তো তোমরা পড়ার চাপে মজাই করতে পার না।

হ্যালো: ছোটবেলায় কি করতে পছন্দ করতেন?

মুস্তাফা মনোয়ার: ছোটবেলায় আমার বাড়িতে অনেক গানবাজনা হতো। গান বাজনা করতেই অনেক ভালো লাগত। ছোটবেলায় একটা গান আমার খুব প্রিয় ছিল- ‘তুম নে মুঝকো প্রেম শিখায়া’। গানটি খুব গাইতাম। তখন তো এর অর্থ বুঝতাম না।

এছাড়াও বাবার ক্যামেরা ছিল, তা দিয়ে ফটোগ্রাফি করতাম। ক্লাস ফাইভে থাকতেই আমি ছবি তুলে তা ওয়াশ করতে শিখে ফেলি।

হ্যালো: ছোটবেলার মজার কোন ঘটনা ?

মুস্তাফা মনোয়ার: আমি তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ি। গণিত আমার জন্যে ছিল খুব যাচ্ছেতাই বিষয়। পরীক্ষার পর শিক্ষক সবার নম্বর বলছেন। এক সময় খানিকটা সময় নিয়ে একটা খাতা দেখছেন। পরে জিজ্ঞেস করলেন, মুস্তাফা মনোয়ার কে? আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, জান তুমি গণিতে কত পেয়েছো?

আমি বললাম, না স্যার।

বললেন, তুমি চার পেয়েছো।

শুনে আমি জোরে হেসে ফেলেছি, আমার সে কি আনন্দ! আমার আনন্দে স্যারসহ সবাই অবাক। কারণ জানতে চাইলে আমি বললাম, স্যার আমার কোন একটা অঙ্ক যে ঠিক হয়েছে সেটা ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।  

হ্যালো: আপনার ছেলেবেলার বন্ধুদের কথা মনে আছে?      

মুস্তাফা মনোয়ার: আমার বাড়ির আশেপাশের শিশুরাই ছিল আমার বন্ধু। আর একজন ছিল খুব প্রিয়। ওর বাবার পুরনো লোহালক্কড় বেচার দোকান ছিল। ওর মা আমাকে খুব আদর করতেন। দুটো জিলিপি কিনে এনে আমাদের দুজনকে ভাগ করে দিতেন। আসলে এর বেশি সামর্থ্য ছিল না ওদের। ওরা ছিল খুব গরিব।  কিন্তু কোন শ্রেণির শিশুর সঙ্গে মিশছি এ নিয়ে আমার পরিবারের কোন বাধা-নিষেধ ছিল না। বুবুরা শুধু খেয়াল রাখতেন খেলতে গিয়ে কোন বিপদ যেন না ঘটাই।  

হ্যালো: ছোটবেলায় কার আদর বেশি পেয়েছেন?  

মুস্তাফা মনোয়ার: মা মারা যান আমার তিন বছর বয়সে। আমাকে মানুষ করেছেন আমার বুবুরা। সবার ছোটো ছিলাম আর তাই খুব আদরে বড় হয়েছি।   

হ্যালো: ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতেন?

মুস্তাফা মনোয়ার: হ্যাঁ, এক্কেবারে ছোটোবেলা থেকেই। আমার বন্ধু ছিল নাহার। ও বলল, ওকে ছবি এঁকে দিলে দু’আনা পয়সা দেবে। সেই লোভেই আমি আঁকলাম। তারপর সেই সেই দু’আনা পয়সা পেয়ে আমার খুশি আর ধরে না। কত কিছু যে তখন কেনা যেত সেই দু’আনাতেই! এছাড়া নানা ক্রিয়েটিভ কাজ করতাম। এখন তো শিশুরা ক্রিয়েটিভ কাজ করারা সময়ই পায় না। সারাক্ষণ বাবা-মায়েরা ওদের পড়াশোনার চাপে রাখছে। ফলে শিশুর ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট হচ্ছে।

হ্যালোঃ কোনো মজার ঘটনা বলুন।

মুস্তাফা মনোয়ার: আমার প্রথম উপার্জনের গল্পটা তোমাকে শোনাই। তখন মাড়োয়ারিরা মারা গেলে শব দাহ করতে নিয়ে যাবার পথে পয়সা ছিটানো হতো। সবার সাথে পড়িমরি করে আমিও পয়সা কুড়াতে লাগলাম। শার্ট-মার্ট ছিঁড়ে একাকার। বাড়ি ফিরে বুবুকে আমার প্রথম উপার্জনের পয়সা দেখাতেই বুবু এই মারে কি সেই মারে। কী যে বকুনি খেতে হয়েছে সে আর কী বলব! আর কখনো ও রকম করব না প্রতিজ্ঞা করতে হলো।  

হ্যালো: শিশুদের কাজ বা ভাবনাকে কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত?

মুস্তাফা মনোয়ার: একটা গল্প বলি শোন। রবীন্দ্রনাথের নাতনি একটি ভাঙা ছাতার লাঠিকে ঘোড়া বানিয়ে খেলছিল। দাদুকে দেখে সে বলল, দেখেছো আমি ঘোড়ায় চড়েছি। রবীন্দ্রনাথও সুর মিলিয়ে বললেন, সে তো আমি দেখতেই পাচ্ছি কেমন চমৎকার একটা পঙ্খিরাজে তুমি উড়ে বেড়াচ্ছো!

রবীন্দ্রনাথ কি তাহলে তার নাতনিকে মিথ্যে বলেছিলেন? তা নয়, তিনি নাতনির ভাবনার জগতটাকে উৎসাহিত করেছিলেন। যা আমাদের প্রত্যেকেরই শিশুর সাথেই করা উচিত।

আমি বলি কি, পড়ার ফাঁকে ক্রিয়েটিভ কাজ নয়। বরং ক্রিয়েটিভ কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়া, এটাই হওয়া উচিত।     

হ্যালো: শিশুরাও ক্রমে হিন্দি সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকছে, এটা কি তাদের জন্য ক্ষতিকর?

মুস্তাফা মনোয়ার: খুবই ক্ষতিকর। শুধু শিশুরা নয় সবার জন্যই ক্ষতিকর। এখন তো শিশুদের কথা চিন্তা করে ভালো অনুষ্ঠানও হচ্ছে না। তাই এদিকটাতে খেয়াল দেওয়া খুবই দরকার। তুমি কি বিটিভির ছোটোদের খবর শুনেছো কখনো? ওরকম অনুষ্ঠান আর হয় না। আমরা বড়রা আসলে তোমাদের জন্যে ভালো কিছু করতে পারছি না।