নারী উত্ত্যক্তকরণ একটি সামাজিক ব্যাধি এবং নারী উন্নয়নে বাধা। নারীরা আজ অনেক এগিয়ে। তারা আজ আর চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নেই। প্রয়োজনের তাগিদে জীবন ধারণের জন্য আত্মবিকাশ, আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন কাজে নিজেকে যুক্ত করছে।

স্কুল-কলেজে পড়াশোনা, অফিস-আদালত, মাটি কাটা, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ, মাঠ ও গৃহস্থালির কাজসহ সব ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার জন্য যে পরিবেশ তৈরি হওয়া প্রয়োজন তা এখনো পুরোপুরিভাবে তৈরি হয়নি।

বর্তমানে নারীরা যেমন ঘরে নিরাপদ নয় তেমনি বাইরেও নয়। কারণ নারীর প্রতি সহিংসতার হার বৃদ্ধিসহ নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে উত্ত্যক্তকরণ। এই নিগ্রহের ফলে সমাজে নারীর প্রতি প্রতিনিয়ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

উত্ত্যক্তকরণ বিষয়টি আমাদের সমাজে নতুন না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি বড় ধরণের রূপ ধারণ করেছে।

উত্ত্যক্তকরণ বলতে একজন মানুষের প্রতি অপর একজনের অশালীন আচরণ বা অঙ্গভঙ্গিকে বোঝায়। উত্ত্যক্তের ঘটনা সাধারণত রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য স্থানে ঘটে থাকে।

ইঙ্গিত করে কটু বা অশালীন মন্তব্য করা, শিস দেয়া বা সিটি বাজানো, অশোভন বা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি বা ইশারা করা, মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিরক্ত করা ইত্যাদিকে উত্ত্যক্ত বলা হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়ে সামাজিকভাবে যৌন হয়রানির শিকার।

উত্ত্যক্ত করার ফলে স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নারীর সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে।

অনেক সময় ভুক্তভোগী নারীরা তাদের জীবন দিয়ে দিচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের তথ্যমতে, উত্ত্যক্তকরণের ঘটনায় ২০১০ এর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩১ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন আট জন। উত্ত্যক্তকরণের ঘটনায় লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনশ দুই জন নারী ও একশ ১৮ জন পুরুষ। উৎপাতের ভয়ে স্কুল কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়েছে ৬১ জন ছাত্রীর। শুধু উত্ত্যক্তকারীদের উৎপাতের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক মেয়ের লেখাপড়া, বাড়ছে বাল্যবিবাহ।

আমাদের এই সমাজে নারী উত্ত্যক্তকরণকে কেন্দ্র করে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন, একজন নারী কোনো পুরুষ দ্বারা উত্ত্যক্ত হলে পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশিরা প্রায় সময়ই মেয়েটিকে তার আচরণ ও পোশাক পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়। এভাবেই আমাদের সমাজের মানুষেরা মেয়েটিকে তথাকথিত সংশোধনের কথা বলে ছেলেটির খারাপ আচরণকে প্রশ্রয় দেন সচেতন বা অবচেতনভাবে। এছাড়াও উত্ত্যক্তকরণ যে একটি অপরাধ তা নিয়েও সমাজে রয়েছে সচেতনতার অভাব। ছেলেরা মেয়েদের দেখলে একটু বাঁকা উক্তি, হাসাহাসি করবে এটাই যেন স্বাভাবিক!

উত্ত্যক্তকরণ যৌন নিপীড়নের একটি ধরণ। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা হয়েছে, ‘‘কোনো পুরুষ অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনার উদ্দেশ্যে কোনো নারীর প্রতি অশ্লীল বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করলে তার এই কাজকে বলা হবে যৌন হয়রানি এবং তার জন্য উক্ত পুরুষ অনধিক সাত বৎসরের বা ন্যূনতম দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’’

যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যাটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ সমস্যা দূর করতে পরিবার থেকেই ছেলে-মেয়ে উভয় শিশুকে বোঝাতে হবে নারী-পুরুষ সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের, সহযোগিতার এবং সম মর্যাদার। এছাড়াও সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা, সংবেদনশীলতা এবং মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাছাড়াও সরকারি উদ্যোগে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে উত্ত্যক্তকরণ বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পাশাপাশি ছেলেমেয়ের সম্পর্ক যাতে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে হ্যালোডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৮ মার্চ ২০১৮